ঢাকার গণ্ডি পেরিয়ে আর্ট ক্যাটালগ এখন সারাদেশে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছেছে

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ৪০,০০০ আর্ট ক্যাটালগ, ফোলিও ও বই ৭০টি শাখা, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে সফল হস্তান্তর করা হয়। এ উপলক্ষে ২৮ এপ্রিল ২০১৬ বৃহস্পতিবার ঢাকার  সোনারগাঁও প্যান প্যাসিফিক হোটেলের সুরমায় এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন

আধুনিক ও সমকালীন শিল্পকলার জগতে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আনুষ্ঠানিক প্রবেশ ঘটে ২০০০ সালে বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টস্ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় গ্যালারি, বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জ। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পক্ষে গ্যালারির কার্যক্রম পরিচালনার পেছনে ছিল শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর দৃঢ় অঙ্গীকার। ঢাকায় শিল্পকর্ম প্রদর্শন ও বিক্রয়ের জন্য যথাযথ প্রদর্শনালয় নির্মাণ, মানসম্পন্ন প্রদর্শনী আয়োজন, তথ্যসংবলিত ক্যাটালগের প্রকাশনা-সৌকর্য নিশ্চিতকরণ এবং শিল্পকর্ম বিপণন ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করে শিল্পীদের স্বার্থসংরক্ষণকে ধারাবাহিকভাবে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। গত পনেরো বছরের আমাদের এই একটানা প্রয়াস এবং সরকারি ও বেসরকারিভাবে আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে আজ বাংলাদেশে শিল্পকলার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। আরো কমার্শিয়াল গ্যালারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দেশেই তৈরি হয়েছে উৎসাহী সংগ্রাহকের দল। ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বিস্তৃত হয়েছে সমঝদার ও আগ্রহী দর্শকের পরিধি। আমাদের শিল্পকর্মের বাজার এখনো আন্তর্জাতিকভাবে ততটা বিস্তৃত না হলেও, দেশেই এর একটা সুষ্ঠু চাহিদা তৈরি হয়েছে।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ভিজুয়াল আর্টস প্রোগ্রামে জ্ঞানচর্চা এবং অনুশীলন সবসময়ই গুরুত্ব ও তাৎপর্যের সঙ্গে বিবেচিত হয়ে এসেছে। শিল্পীদের কাজ সহজতর করতে নানা বিষয়ে পরামর্শ ও সহায়তা দান, উচ্চশিক্ষা, রেসিডেন্সি অথবা অনুশীলন অব্যাহত রাখতে অনুদান প্রদান, স্কলারশিপ ও গ্রান্ট ইত্যাদি কার্যক্রম বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সূচনাকাল থেকেই অব্যাহত রয়েছে। দেশজুড়ে শিল্পকলার চর্চা ও প্রসারে সরাসরি অথবা অন্য কারো প্রচেষ্টাকে আরো সুসংহত করতে আমরা বরাবরই পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। ঢাকায় সফিউদ্দীন বেঙ্গল প্রিন্টমেকিং স্টুডিও এবং নড়াইলে এসএম সুলতান বেঙ্গল আর্টস কলেজ প্রতিষ্ঠা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ২০১১ সালে ভেনিস বিয়েনালে বাংলাদেশের প্রথম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন কার্যকর ভূমিকা পালন করে। শিল্পকলা-বিষয়ে জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসা লালন, শিল্পীদের নিরীক্ষাধর্মী চিন্তার প্রসার ও গ্যালারির গ-ির বাইরে শিল্পের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ ঘটাতে এবং শিল্পকলার বিভিন্ন শাখার মধ্যে মেলবন্ধন তৈরির প্রয়াসে ২০১৪ সালে স্থাপন করা হয় দ্য ডেইলি স্টার-বেঙ্গল আর্টস প্রিসিঙ্কট। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের বিশ্বে পরিচিত করাতে আমরা ইতালির স্বনামধন্য প্রকাশক স্কিরার সঙ্গে একযোগে আন্তর্জাতিক বাজারের উপযোগী বই (মনোগ্রাফ) প্রকাশ করেছি। ২০১৪ সালে আমাদের সুহৃদ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি ও বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালক প্রয়াত সুবীর চৌধুরীর নামে আমরা প্রণয়ন করেছি এ দেশের সবচেয়ে বড় আর্ট প্র্যাকটিস গ্র্যান্ট। এছাড়া বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী-আয়োজিত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে কৃতী শিল্পীদের ১৯৯৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আর্ট অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়ে থাকে। আমিনুল ইসলাম শ্রেষ্ঠ নবীন শিল্পী পুরস্কার ও হামিদুর রহমান পুরস্কারও আমরা পরিচালনা করে থাকি।

শিল্পীদের মর্যাদা, সমাজ ও রুচিগঠনে তাঁদের অবদান এখন সর্বজনস্বীকৃত। এই সবকিছুতেই যৎসামান্য অবদান রাখতে পেরে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন সত্যিই গর্বিত।

গণগ্রন্থাগার ও আর্ট পাবলিকেশন

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা গণগ্রন্থাগারগুলোর মাধ্যমে এই অধিদপ্তর, জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে একটি আলোকিত সমাজ গড়ে তোলায় আগ্রহী। দেশের ৬৪টি জেলায় অবস্থিত গণগ্রন্থাগারের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ পাঠক ও শিল্পানুরাগীদের হাতে আজ যেসব গ্রন্থ ও আর্ট ক্যাটালগ তুলে দেওয়া হয়েছে, আমাদের বিশ্বাস এর ফলে বৃহত্তর পাঠক বাংলাদেশের চিত্রকলা প্রয়াসের উচ্চতর বোধ ও আন্তর্জাতিক মান সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন, যা জাতীয় রুচি গঠনে সহায়ক হবে। ঢাকা-কেন্দ্রিক শিল্পচর্চার গ-ি পেরিয়ে বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পচর্চার বার্তা নিয়ে এই ক্যাটালগগুলো আজ দেশের সর্বত্র পৌঁছে গেছে। এ কখনোই সম্ভব হতো না সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের সহযোগিতা ছাড়া। আর্ট ক্যাটালগ ও বইয়ের জন্য গণগ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ প্রতিটি গ্রন্থাগারে বিশেষ একটি স্থানও বরাদ্দ করেছেন, যাতে আগ্রহী পাঠক এধরণের বই সব একসঙ্গে পান। সরকারের হাতে দেশব্যাপী যে ভৌত অবকাঠামো ও জনবল আছে, তার সঙ্গে আমাদের হাতে যে শিল্পবিষয়ক পাঠ্যসম্পদ রয়েছে এই দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটিয়ে শিল্পকে মানুষের আরো কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার আমাদের যে সম্মিলিত প্রয়াস, তা আজ রূপায়িত হলো।

গত ডিসেম্বর মাসে এ-বিষয়ে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বিশেষ সহযোগিতায় এবং সকলের সম্মতিক্রমে এ-বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে, অর্থাৎ ৬০ দিনের মধ্যে ৭০টি বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও শাখা গণগ্রন্থাগারে ক্যাটালগগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিটি গ্রন্থাগারে বিশেষ মোড়কে কাঠের বাক্সে ২৩৭টি আইটেমের ৫৬৪টি ক্যাটালগ হস্তান্তর করা হয়।
আর্ট ক্যাটালগ প্রদানের বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর এবং সংস্কৃতি সচিব মহোদয় আকতারী মমতাজের ব্যক্তিগত উৎসাহ আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। এছাড়া গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মহোদয় আশীষ কুমার সরকার ও তাঁর সকল সহকর্মীদের প্রতি তাঁদের আন্তরিক সহযোগিতার জন্য আমরা সবিশেষ কৃতজ্ঞ।
পাঠ্যসম্পদ
গত পনেরো বছরে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ২৩৭টি শিরোনামের আর্ট ক্যাটালগ, ফোলিও, বই ও ফোল্ডারে যা রয়েছে তার কিছু বৈশিষ্ট্য –
* প্রায় ১২০০ শিল্পীর কাজের প্রতিলিপি, শিল্পীর সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং প্রদর্শনী ও শিল্পরীতি সম্বন্ধে শিল্প-সমালোচকের প্রবন্ধ ক্যাটালগে পত্রস্থ করা হয়েছে।
* শিশুশিল্পীদের কাজের প্রতিলিপি
* নানা শিল্পশৈলী – মডার্ন, কনটেম্পরারি, বাস্তববাদী, অ্যাবস্ট্র্যাক্ট ইত্যাদি
* বিভিন্ন শিল্পভাষা ও করণকৌশল – ছাপচিত্র (প্রিন্ট), পেইন্টিং, ভাস্কর্য, নিউ মিডিয়া, ফটোগ্রাফি
* বাংলাদেশের ১০০জন শিল্পীর সিরিজ ‘শেকড়ে ও সৃজনে’
* ৯টি ফোলিও – মনিরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন, আবদুর রাজ্জাক, নাজিয়া আন্দালিব, কাইয়ুম চৌধুরী, রোকেয়া সুলতানা, শাহাবুদ্দিনসহ ৪০জন শিল্পীর কাজ (বাংলাদেশের ৪০তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মুদ্রিত), শিল্পীর চোখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইত্যাদি
* বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ও আবুল খায়েরের নিজস্ব সংগ্রহে থাকা ছবির প্রতিলিপি
* আধুনিক শিল্পচর্চার পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন,কামরুল হাসান, এস এম সুলতান; ষাট ও সত্তরের দশকের শিল্পী মোহম্মদ কিবরিয়া, সফিউদ্দীন আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশির, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, কাইয়ুম চৌধুরী, মুস্তাফা মনোয়ার, নভেরা আহমেদ প্রমুখ; হাশেম খান, মাহমুদুল হক, রফিকুন নবী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, নিতুন কু-ু; কালিদাস কর্মকার, শহীদ কবির, মনিরুল ইসলাম, নাজলী লায়লা মনসুর, আবদুস শাকুর, মনসুরুল করিম, অলোক রায়, রণজিৎ দাশ, রোকেয়া সুলতানা, শেখ আফজাল, মোহম্মদ ইউনুস; আনিসুজ্জামান, মোহম্মদ ইকবাল, তাসাদ্দুক হোসেন প্রমুখ
* উত্তরাধিকার ও আঞ্চলিক রীতি – যাঁদের চিন্তা ও প্রয়াস আমাদের শিল্পচর্চাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে যেমন যামিনী রায়, হরেন দাস, বিজন চৌধুরী, গোপাল ঘোষ, পরিতোষ সেন, গনেশ হালুই, যোগেন চৌধুরী, সর্বরী রায়চৌধুরী, সনৎ কর, ধীরাজ চৌধুরী, সোমনাথ হোর প্রমুখ নিয়ে ক্যাটালগ
* বিদেশী শিল্পী – বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত অষ্টাদশ শতাব্দীর স্প্যানিশ শিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়ার এচিং; আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাস্কর হেনরি ম্যুর ও ১৮জন সমসাময়িক বৃটিশ ভাস্কর; ভারত, চীন, জাপান, কোরিয়া, নরওয়ে, ফ্রান্স, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ইত্যাদি দেশর শিল্পী ও ভাস্করের কাজ
* স্কিরা-বেঙ্গল বই – শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ ও কাজী গিয়াসউদ্দিনের মনোগ্রাফ
* আলোকচিত্র- ড. নোয়াজিশ আহমেদ, গাজি নাফিজ, জিএমবি আকাশ, নিমাই ঘোষ, ট্রেন্ট পার্ক, মরটন ক্রভগোল্ড, রঘু রায়, বাবু আহমেদ, নাইমুজ্জমান প্রিন্স প্রমুখ। স্থপতিদের
* মহিলা শিল্পী – ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিনী, কনকচাঁপা চাকমা, নাসরীন বেগম, ফরিদা জামান, নাজলী লায়লা মনসুর, মাকসুদা ইকবাল নীপা প্রমুখ। ’সাঁকো’ সংগঠন ও মহিলা শিল্পীদের বিভিন্ন দলীয় প্রদর্শনীর ক্যাটালগ
* সমকালীন চর্চা / নিউ মিডিয়া – দিলারা বেগম জলি, তায়েবা বেগম লিপি, ইয়াসমীন জাহান নুপুর, মুস্তফা জামান, ঢালি আল মামুন, মাহবুবুর রহমান, ওয়াকিলুর রহমান প্রমুখ
* নবীন শিল্পী – রনি আহমেদ, রফিকুল শুভ, আনিসুজ্জামান সোহেল, ময়েজউদ্দিন, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, জামিল আকবর শামীম, মো. টোকন প্রমুখ
* বিদেশে বাংলাদেশের শিল্পী – সৈয়দ ইকবাল, ফিদা হক, মোহম্মদ ফকরুজ্জামান, মুরশিদা আরজু, আলমগীর হক, রুহুল আমিন কাজল প্রমুখ।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন প্রকাশিত আর্ট ক্যাটালগ, ফোলিও ও বই ৭০টি উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে হস্তান্তর তালিকা

Enter your keyword